Thursday, July 25, 2024
Homeঅর্থনীতিইতালিতে কর্মী নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ‘মাফিয়ারা’ ঢুকে পড়ার অভিযোগ

ইতালিতে কর্মী নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ‘মাফিয়ারা’ ঢুকে পড়ার অভিযোগ

ইতালিতে কর্মী নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ‘মাফিয়ারা’ ঢুকে পড়ার অভিযোগ করে সেখানে বাংলাদেশিদের ক্ষেত্রে ভিসা ‘কেনাবেচার’ কথা তুলে ধরেছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী জর্জা মেলোনি।

সম্প্রতি মন্ত্রিপরিষদের এক বৈঠকে ইতালির প্রধানমন্ত্রীর এসব বক্তব্য দেওয়ার কথা এক সরকারি বিজ্ঞপ্তিতে তুলে ধরা হয়েছে।

বিভিন্ন অঞ্চলে শ্রম ভিসায় ঢোকার ব্যক্তিদের তুলনায় কাজের চুক্তি সইয়ের পরিমাণ অতি নগন্য হওয়ার কথা তুলে ধরে জর্জা মেলোনি বলেন, “এর মানে কী? আমাদের ধারণা, কাজের জন্য বৈধ অভিবাসনের প্রক্রিয়াকে অবৈধ অভিবাসনের কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে।

“তার মানে হচ্ছে, সংগঠিত অপরাধীচক্র আবেদন প্রক্রিয়ায় অনুপ্রবেশ করেছে এবং এক্ষেত্রে তারা ‘বৈধ পথে ঢোকার ডিক্রিকে’ ব্যবহার করে আইনি ও ঝুঁকিমুক্তভাবে এমন লোকদের ইতালিতে প্রবেশ করাচ্ছে, যারা এমনিতে প্রবেশ করতে পারত না।”

একক দেশ হিসাবে বাংলাদেশ থেকে অধিকাংশ ব্যক্তির কাজের ভিসায় ঢোকাকে ‘অপরাধীদের অনুপ্রবেশের’ প্রমাণ হিসাবে তুলে ধরেন মেলোনি। তিনি বলেন, “কূটনৈতিক কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশে সেখানে কাজের ভিসা বেচাকেনা করার কথা বলেছে।”

ভিসার কেনাবেচার ক্ষেত্রে ১৫ হাজার ইউরো পর্যন্ত হাতবদল হওয়ার কথাও বলেন ইতালির প্রধানমন্ত্রী মেলোনি।

চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে ইতালিতে অবৈধ অভিবাসীদের হিসাবে বাংলাদেশিরা এক নম্বরে থাকার কথা তুলে ধরে ইতালির প্রধানমন্ত্রী বলেন, “এর মাধ্যমেও উৎস ও গন্তব্য দেশের অপরাধী সংগঠনের মধ্যে জোরালো সংযোগের বিষয় উঠে আসে।”

ইতালিতে কর্মী সংকট কাটাতে ও অবৈধভাবে দেশটিতে প্রবেশ বন্ধ করতে ২০২২ সালে বিপুল সংখ্যক কর্মী নেয়ার ঘোষণা দেয় ইতালি।

এর আওতায় ২০২৩ সাল থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত তিন বছরে ধারাবাহিকভাবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাইরের ৩৩টি দেশ থেকে প্রাঁয় পাচ লাখ কর্মী নেওয়ার প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের আবেদন প্রক্রিয়ায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কর্মী আবেদন করেন বৈধভাবে দেশটিতে প্রবেশের জন্য।

খুব দ্রুত প্রক্রিয়া শেষ করে দেশটিতে বৈধভাবে প্রবেশ করলেও দেশটিতে পৌঁছানোর পর নির্দিষ্ট মালিকের সঙ্গে কাজ না করে বা নির্দিষ্ট মেয়াদের পর থেকে গিয়ে অবৈধ হয়ে যাচ্ছেন এসব কর্মী। এরমধ্যে বাংলাদেশি কর্মীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এছাড়া ইতালির কাজের ভিসা নিয়ে বাংলাদেশে ‘ব্যাপক দুর্নীতির’ অভিযোগও আসছে।

গত সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রী জর্জা মেলোনির দপ্তর পালাজ্জো কিজি থেকে নতুন এক নির্দেশনা দেওয়া হয়। মন্ত্রী পরিষদের সেক্রেটারি আলফ্রেদো মানতোভানো প্রধানমন্ত্রী নির্দেশে এ নির্দেশনা সম্পর্কে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অবহিত করেন।

সেখানে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী জর্জা মেলোনি অবৈধ অভিবাসীদের প্রবেশ বন্ধে সব ধরনের চেষ্টা করে যাচ্ছেন। গতবছরের তুলনায় এবছর এই সময়ে ৬০% অভিবাসী কম প্রবেশ করেছে। এজন্য তিনি (জর্জা মেলোনি) উত্তর আফ্রিকার দেশ ও তিউনিসিয়া এবং লিবিয়াকে ধন্যবাদ জানান।

“তবে তিনি এবার আরো একটা সমস্যার কথা স্পষ্ট করে বলেছেন। বিভিন্ন দেশের কর্মীরা বৈধভাবে ইতালিতে প্রবেশ করলেও পরবর্তীতে তারা অবৈধ হয়ে যাচ্ছে।”

২০২৩ সালে ১ লাখ ৩৬ হাজার কর্মী আসার কথা থাকলেও এরজন্য ২ লাখ ৮২ হাজার কর্মী আবেদন করেন। তবে শুধুমাত্র দেশটির “কামপানিয়া” অঞ্চল থেকে ১ লাখ ৫৭ হাজার আবেদন জমা পরে। আর ২০ হাজার আসে অন্য অঞ্চল পুয়িয়া থেকে। যেখানে কিনা পুয়িয়াতে ১২% কোম্পানি রয়েছে ইতালিয়ান নাগরিকদের আর সবচেয়ে বেশি আবেদন করা কামপানিয়ায় মাত্র ৬% কোম্পানির মালিক ইতালিয়ান।

এদিকে ২০২৩ সালে কামপানিয়ায় প্রবেশ করা কর্মীদের মধ্যে মাত্র ৩% কর্মী মালিকের সাথে কাজ করলেও ৯৭% থেকে যায় অবৈধ। যাদের মধ্যে বেশিরভাগ মৌসুমি কর্মী নির্দিষ্ট সময় শেষে নিজ দেশে ফিরে যাননি।

বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে পর্যবেক্ষণ করছেন প্রধানমন্ত্রী জর্জা মেলোনি। এ নিয়ে দেশটির তদন্তে মানবপাচার ও ভিসা কেনা-বেচার মত তথ্য পেয়েছে দেশটির মন্ত্রিপরিষদ।

বিশেষ করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঘোষিত প্রজ্ঞাপনে বাংলাদেশি অভিবাসী ও কর্মীদের কথা তুলে ধরে বলা হয়েছে, দেশটিতে ইতালির ভিসা কেনা-বেচার তথ্য পেয়েছে ঢাকায় ইতালির দূতাবাস।

ইতালির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বাংলাদেশে ইতালির ভিসা ১২ হাজার থেকে ১৫ হাজার ইউরো করে কেনা-বেচা হয়। বাংলাদেশ ও ইতালিতে থাকা কিছু সংঘবদ্ধ চক্র এর সঙ্গে জড়িত, যারা নামে-বেনামে শুধুমাত্র কাগজে-কলমে কোম্পানি বানিয়ে মানবপাচার করছে। চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে ইতালিতে অবৈধ হয়ে পড়া অভিবাসীদের মধ্যে বাংলাদেশিরা রয়েছে শীর্ষস্থানে।

এসব মানবপাচার ও ভিসা কেনা-বেচার সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দেশটির আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ‘এন্টি-মাফিয়া’ গ্রুপের প্রসিকিউটর জোভান্নি মেলিল্লোকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এছাড়া অবৈধ অভিবাসীদের নিজ দেশে ফেরাতে নতুন কৌশল নিয়ে চিন্তাভাবনার কথা বলা হয়েছে।

ইতালির স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র, কৃষি ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছে।

সেখানে বলা হয়, দেশটিতে বর্তমানে দক্ষ কর্মীদের সংকট রয়েছে। এই সংকট মোকাবিলায় অন্যান্য দেশ থেকে কর্মী নিতে তারা ভিন্ন পরিকল্পনার কথা ভাবছে, যেখানে মধ্যস্থতাকারী ছাড়া বিদেশি দক্ষ কর্মী নিয়োগের সুযোগ তৈরি করা হবে।

এ বিষয়ে দায়িত্ব নেওয়ার পর দেশটির এন্টি-মাফিয়া দলের প্রসিকিউটর বলেন, “মন্ত্রিপরিষদের নির্দেশে আমরা ইতালিতে শ্রমিক প্রবেশের প্রতিটি ধাপ এখন থেকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করব। সব ধরনের মানবপাচারের বিরুদ্ধে আমরা কঠোর অবস্থানে কাজ করে যাচ্ছি। এখন থেকে প্রতিটি কোম্পানির সকল ধরনের তথ্য যাচাই-বাছাই শেষে আবারো পুনরায় আমরা যাচাই বাছাই করে শ্রমিক আনার অনুমতি দেব”।

দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সমীক্ষা অনুযায়ী, বৈধভাবে এবং অবৈধভাবে দুইভাবেই এবছর দেশটিতে বাংলাদেশি নাগরিকরা প্রবেশ করেছে সবচেয়ে বেশি। এক দিকে চলতি বছরের প্রথম ৫ মাসে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে অবৈধভাবে প্রবেশ করেছে সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশি। আবার গত দুই বছরে বৈধ প্রক্রিয়ায় ইতালিতে প্রবেশের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশিরা শীর্ষে আছে।

২০২২ সালে ইউরোপের দেশটিতে প্রবেশ করা মোট বিদেশি কর্মীর মধ্যে ৪৫.৪ শতাংশ ছিল বাংলাদেশি। আর ২০২৩ সালে ৬১.১ শতাংশ এবং ২০২৪ সালের এখন পর্যন্ত ৫১.১ শতাংশ বাংলাদেশি কর্মী সে দেশে প্রবেশ করেছে।

ইতিালির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, এদের বেশিরভাগই ইতালিতে সিজনাল ভিসায় এসে স্থায়ীভাবে থেকে যাচ্ছেন, নয়ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্যান্য দেশে পালিয়ে যাচ্ছেন।

অভিবাসীদের নিয়ে কাজ করা ইতালি প্রবাসী বাংলাদেশি মাহফুজুর রহমান বলেন, “ইতালির সরকার সবসময় বিভিন্ন দেশ থেকে দক্ষ শ্রমিক আনার চেষ্টা করে। কিন্তু কিছু এজেন্সি এবং অসাধু দালাল বিপুল পরিমাণ অর্থের বিনিময়ে অদক্ষ শ্রমিকদের ইতালিতে এনে দিচ্ছে। তারা এখানে আসার পরে নির্দিষ্ট সময় শেষ হলেও দেশে ফিরে যাচ্ছে না। বরং তারা অন্যান্য দেশে পালিয়ে যাচ্ছে অথবা অবৈধ অভিবাসীদের মত এখানে বসবাস করছে। বিষয়গুলো ইতালির বর্তমান প্রধানমন্ত্রী গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন।”

তিনি বলেন, “ভিসা বেচা এবং কেনা দুটি অবৈধ কাজ। তাই এসব কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। এছাড়া অবৈধ অভিবাসীদের এদেশ থেকে বিতাড়িত করতে নানা ধরনের পদক্ষেপ হাতে নিচ্ছেন।”

ইতালি সরকারের এমন বক্তব্যের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশি কর্মীদেরকে কেবল ‘নির্ভরযোগ্য এজেন্সির’ ওপর আস্থার রাখার পরামর্শ দিয়েছেন ঢাকায় ইতালির রাষ্ট্রদূত আন্তোনিও আলেসান্দ্রো।

শনিবার কয়েকটি সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি এই পরামর্শ দেন। রোববার ঢাকায় ইতালি দূতাবাসের ওয়েবসাইটে তার ওই সাক্ষাৎকার প্রকাশ করা হয়।

রাষ্ট্রদূত বলেন, কর্মীদের নিশ্চিত হতে হবে তারা কোথায় কাজ করতে যাচ্ছে, কোন অবস্থায় কী ধরনের চাকরি এবং ইতালির কোন শহরে তারা যাচ্ছে। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

প্রতি পাঁচজনে একজন ভিসা আবেদনকারীর কাছ থেকে ‘অবৈধ কাগজপত্র’ পাওয়ার কথা তুলে ধরে রাষ্ট্রদূত বলেন, “ইতালিতে পাঠানোর ক্ষেত্রে মধ্যস্বত্বভোগীদের বেশ বড় অঙ্কের অর্থ দেওয়ার চর্চা রয়েছে। এই কাজ অবৈধ, যা ইতালি ও বাংলাদেশ দুই জায়গাতেই হচ্ছে।”

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -

Most Popular

Recent Comments