ঢাকায় ঘূর্ণিঝড় রেমালের আঘাতে প্রাণ গেছে প্রায় তিনশ বড় আকারের গাছের। এসব গাছের বেশিরভাগই ছিল বিভিন্ন সড়কের মিডিয়ান, ফুটপাত, সড়কদ্বীপে। বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, বাড়িঘরের গাছও ভেঙেছে ওই ঝড়ে।
দুই সিটি করপোরেশনের হিসাবে, ঢাকার উত্তরে ২০০টি এবং দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় ভেঙে পড়া গাছের সংখ্যা ৯৪টি। এই তালিকায় ছোট, গুল্ম বা লতাজাতীয় গাছ আসেনি।
গত রবি ও সোমবার ঘূর্ণিঝড় রেমালে রাজধানীতে যে পরিমাণ গাছ ভেঙেছে, নিকট অতীতে কোনো ঝড়ে এত বেশি গাছ ভেঙে পড়ার ঘটনা ঘটেনি বলে জানিয়েছেন উদ্ভিদ বিজ্ঞানীরা।
এজন্য তারা গাছ লাগানোয় পরিকল্পনার অভাব, গাছের নিয়মিত পরিচর্যার অভাবকে দায়ী করছেন।
ঢাকায় কত গাছ আছে, তার কোনো সঠিক হিসাব পাওয়া না গেলেও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একটি শহরের আয়তনের ২৫ শতাংশে গাছ থাকতে হয়। ঢাকায় আছে মাত্র ২-৪ শতাংশ।
রাজধানীতে সবুজের পরিমাণ বাড়াতে আরও আলাদা কর্মসূচির আওতায় শহরে তিন লাখ বৃক্ষরোপণের উদ্যোগ নিয়েছে দুই সিটি করপোরেশন। ডিএনসিসির পরিকল্পনায় থাকা দুই লাখ গাছের মধ্যে এরইমধ্যে ৮৫ হাজার ৮৪৫টি গাছ লাগানো হয়েছে। আর ডিএসসিসি এক লাখের মধ্যে ২৫ হাজার গাছ লাগিয়েছে।
গাছ ভাঙল কেন
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিকল্পনা অনুযায়ী গাছ না লাগানো, গাছের শেকড় ছড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় জায়গা না থাকা, উন্নয়নকাজের সময় গাছের শিকড় কেটে ফেলা, জরাগ্রস্ত গাছ অপসারণ না করাসহ বিভিন্ন কারণে এবার গাছ ভেঙেছে বেশি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জসিম উদ্দিনের মতে, বৃক্ষরোপণের আগে-পরে তিনটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। গাছের প্রজাতি নির্বাচন, কোন জায়গায় গাছ কোন গাছ রোপণ করা হবে এবং বৃক্ষরোপণের পর সেগুলোর ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডট্কমকে বলেন, “যেসব গাছের চারা ঢাকায় রোপণ করা হচ্ছে সেগুলো পলিথিন বা টবে জন্মানো হয়। এতে প্রাথমিক মূলটা বাড়তে পারে না, জমাটবদ্ধ হয়ে যায়। ওই গাছ রোপণ করা হলেও মূল শিকড় হয় না।
“সেই চারা তুলে মাটিতে রোপণ করার পর মূল শিকড়টা মাটির গভীরে যেতে পারে না। যতগুলো গাছ পড়েছে, দেখবেন মাটির গভীরে কোনো মূল নাই। বীজ দিয়ে গাছ লাগালে সবচেয়ে ভালো। পলিথিনের চারা হলে মাটিটা বিশেষভাবে বড় গর্ত করে রোপন করা উচিত, যাতে শিকড়টা যেখানে বাড়বে সেখানে যেন পর্যাপ্ত জায়গা থাকে।”
এই উদ্ভিদবিদ বলেন, ঢাকায় গাছের মূল প্রসারণের জন্য পর্যাপ্ত জায়গা না পাওয়াও একটা বড় কারণ। বিভিন্ন সময় গাছের শিকড় কেটে ফেলা হয়।
“এমন জায়গায় গাছ লাগানো হচ্ছে যার চারপাশে কংক্রিট। সড়ক বিভাজক একেবারে সরু, গভীরতা কম, প্রশস্ততাও কম। সেখানে গাছ লাগানো হচ্ছে। একদিকে মাটি ঠিক নাই, কংক্রিটের কারণে সে বাড়তে পারছে না। ড্রেনেজ সিস্টেম, স্যুয়ারেজ লাইন, বিদ্যুৎ, টেলিফোন, ইন্টারনেটসহ নানা ইউটিলিটি সার্ভিস বসাতে গিয়ে শিকড় কেটে ফেলা হয়েছে। শিকড় কাটার ফলে গাছগুলো ভারসাম্যহীন হয়ে যায়, বাতাসে ভেঙে পড়ে।”
পরিবেশ বিষয়ক সংগঠন ‘তরুপল্লবের’ সাধারণ সম্পাদক মোকারম হোসেন আরেকটি পর্যবেক্ষণ তুল ধরেছেন।
তার ভাষ্যে, ঢাকায় লাগানো বেশিরভাগ গাছই বিদেশি। বাংলাদেশের মাটির সঙ্গে এসব গাছের ভালো সংযোগ হয় না।
ঘূর্ণিঝড় রেমালে ভেঙে পড়া গাছ পর্যবেক্ষণ করে তিনি বলেন, “ভেঙে পড়া গাছের একটা বড় অংশ কৃষ্ণচূড়া। এই গাছের কাণ্ড, শিকড়, ডালপালা সবই নরম। আমার পর্যবেক্ষণে দেখেছি, রোববার ঢাকায় যত গাছ পড়েছে তার একটা বড় অংশ কৃষ্ণচুড়া। এই গাছ ফুটপাতে, সড়ক বিভাজকে লাগানো যাবে না।”
তিন লাখ গাছ সঠিক জায়গায়?
দুই সিটি করপোরেশনের পরিকল্পনায় বিভিন্ন সড়কের ফুটপাত, মিডিয়ান, বিভিন্ন পার্কে তিন লাখ গাছ লাগানো হবে। এছাড়া কিছু গাছ লাগানো হবে নিম্ন আয়ের মানুষের বসবাস আছে– এমন এলাকায়।
ডিএনসিসি জানিয়েছে, বড় গাছের মধ্যে কাঠবাদাম, ছাতিম, বকুল, সোনালু, জারুল, রসকাউ এবং শোভাবর্ধনকারী কাটামেহেদী, চায়না টগর এবং রঙ্গন থাকবে সড়কে। আর বৃক্ষরোপণের পরিকল্পনায় দেশীয় গাছকে প্রাধান্য দেওয়ার কথা জানিয়েছে ডিএসসিসি।
প্রকৃতিবিদ মোকারম হোসেন বলছেন, উত্তর সিটি করপোরেশন যে গাছ লাগাচ্ছে সে তালিকা দেখেছেন তিনি। তার মনে হয়েছে ছাতিম, কদম, কাঠবাদাম ফুটপাতের উপাযোগী নয়।
“ছাতিম গাছের ডায়া কত, ডালপালা কোথায় আসবে, কত উপরে থাকবে সেসব বিষয় বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। ফুটপাতের ওপর বৈদ্যুতিক খুঁটি থাকায় গাছের মাথা কেটে দিতে হবে। কদম গাছ এবং কাঠবাদামের ডাল নরম। ঝড় হলে এসব গাছ, গাছের ডাল ভেঙে পড়ার আশঙ্কা থাকে।”
তিনি বলেন, “এভিনিউ ট্রি হিসেবে দেবদারু, স্বর্ণচাঁপাসহ কিছু গাছ আছে যেগুলোর ডাল ভাঙে না। এসব গাছ ফুটপাতে লাগানো যায়। ডিএনসিসি উদ্ভিদ বিন্যাসের যে পরিকল্পনা করেছে, তা উদ্ভিদবিদদের সঙ্গে পরিকল্পনা করে করা হয়নি বলে আমি মনে করি।”
আর ঢাকায় দেশীয় প্রজাতির গাছ না লাগিয়ে বিদেশি গাছের দিকে নগর কর্তৃপক্ষের ঝোঁকের খেসারত দিতে হবে বলে মনে করেন অধ্যাপক মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন।
তিনি বলেন, “ঢাকা সাজাতে হবে ঢাকার আদি বৃক্ষ দিয়ে। বিদেশি বৃক্ষ দিয়ে নয়। কিন্তু আমরা বিদেশি বৃক্ষের প্রতি ঝুঁকছি। বৃক্ষরোপণ একটি বিজ্ঞান। এর বাইরে গিয়ে আবেগের বশবর্তী হয়ে যদি আপনি গাছ লাগান তাহলে তা সাসটেইনেবল হবে না। ঢাকার গাছ নিয়ে এখন যা হচ্ছে তা হতেই থাকবে।”
তবে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেছেন, পারিপার্শ্বিক সবকিছু বিশ্লেষণ করেই ঢাকায় বৃক্ষরোপণ হয়। এরপরও ঝড়ের গতিবেগ বেশি থাকলে গাছ পড়ে যায়।
তিনি বলেন, “আমরা আমাদের কাজ করে যাব। আমরা সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করে নেব কোন গাছ কতটা সহনীয়। আমরা আগামী সপ্তাহে একটি মিটিং করব বৃক্ষরোপণ বিষয়ে। সেখানে বিষয়টা তুলব। কোন গাছ ঝড়ে ভাঙবে না, কোন গাছ বেশি ছায়া দিতে পারে।”
গাছ নির্বাচনে ভুল হচ্ছে– পরিবেশবিদদের এমন মতামতের বিষয়ে তিনি বলেন, “উনারা উনাদের পরামর্শ আমাকে লিখিত আকারে দিতে পারেন। আগামী সপ্তাহে আমি একটা স্টেকহোল্ডারস মিটিং করছি। সেখানে সবার সঙ্গে কথা বলব, সম্মিলিতভাবে যেটা ঠিক হবে আমরা সেটাই লাগাব।”
অন্যদিকে ডিএসসিসির জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. আবু নাছের দাবি করেছেন, ঝড়ে যেসব গাছ পড়েছে সেগুলো বেশিরভাগই ফুটপাতের নয়। বিভিন্ন বাড়িঘরের গাছ সড়কে, ফুটপাতে পড়েছে।
“শক্তপোক্ত গাছ, পর্যাপ্ত মাটি আছে, এমন জায়গা থেকে পড়েছে অনেক গাছ। আমাদের ধারণা বাতাসের তীব্র গতি এবং দীর্ঘ সময় ধরে চলা ঝড়ের কারণে গাছগুলো উপড়ে পড়তে পারে।”
“আমাদের নিজস্ব আরবরিকালচারিস্ট আছেন। এছাড়া বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় গাছ লাগানোর সময় পরামর্শকদের পরামর্শ নেওয়া হয়। এছাড়া আমাদের মেয়র মহোদয়ের নির্দেশনা আছে সড়কে ফুটপাতে দেশি গাছ লাগানোর। বিভিন্ন প্রকল্প এবং গণপরিসর মিলিয়ে এক লাখের বেশি গাছ লাগানো হবে। এরইমধ্যে ২৫ হাজার গাছ লাগানো হয়ে গেছে।”